নিউজিল্যান্ড দেশটি’তে আমি দুইবার গিয়েছি।
প্রথমবার গিয়েছি একটা সেমিনারে, দ্বিতীয়বার কনফারেন্সে।
দেশটার প্রতি কেমন যেন একটা মায়া আছে আমার মাঝে। তাই সব সময় খোঁজ রাখার চেষ্টা করি।
আমরা যারা নিয়মিত লেখালেখি করি রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা রাজনীতি নিয়ে; এই মুহূর্তে সবাই বোধকরি আমেরিকার নির্বাচনের দিকে নজর রাখছি। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
প্রতিদিন অন্তত ঘণ্টা খানেকের জন্য হলেও নজর রাখতে হচ্ছে আমেরিকায় কী ঘটছে কিংবা কোন প্রার্থী কেমন আচরণ করছে ইত্যাদি।
এর মাঝেও নিউজিল্যান্ডের খবর আমি নিয়মিত রেখেছি। হয়ত দেশটির প্রতি মায়া এবং দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেনের কারণে।
জেসিন্ডা হচ্ছে সে-ই প্রধানমন্ত্রী, যিনি কিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সন্তান জন্ম দিয়েছেন। সেই সন্তানকে কোলে নিয়ে সংসদে গিয়েছেন, জাতিসংঘের সম্মেলনে গিয়েছেন।
দেখে মনে হবে- খুব সাধারণ নারী।
অথচ এই নারীই কি শক্ত হাতে কঠিন সব মুহূর্ত সামলেছেন।
নিউজিল্যান্ডের মসজিদে যখন এক সন্ত্রাসী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অনেকগুলো নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে; তখন কী শক্ত হাতে’ই না পুরো বিষয়টাকে সামলেছেন।
যেখানে এইসব বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইংল্যান্ডে বিভেদের রাজনীতি শুরু হয়েছে; অনেক সময় যারা ভিকটিম; তাদেরকে দায়ী করা হয়েছে; সেখানে জেসিন্ডা এক সেকেন্ড সময় না নিয়ে বলেছেন
-যে এই ঘটনা ঘটিয়েছে, সে একজন টেররিস্ট।
যেখানে পশ্চিমা বিশ্বে সন্ত্রাসী বলতে আজকাল স্রেফ মুসলিমদের বোঝানো হয়; সেখানে এই প্রধানমন্ত্রী নিজে বোরকা পড়ে ঘটনায় নিহত হওয়া পরিবারের সদস্যদের সান্তনা দিতে গিয়েছেন। পুরো বিশ্ব দেখেছে- এই প্রধানমন্ত্রী কীভাবে পুরো পরিস্থিতি সামলেছেন।
এই ধরনের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে যেখানে আমেরিকায় রাজনৈতিক দলগুলো নানাভাবে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ইংল্যান্ডে দলগুলো বিভক্ত হবার চেষ্টা করেছে। সেখানে এই প্রধানমন্ত্রী পুরো দেশকে এক করে ফেলতে পেরেছে।
জেসিন্ডা হচ্ছে সেই প্রধানমন্ত্রী, যিনি বিয়ে না করে পার্টনারের সঙ্গে লিভিং সম্পর্কে থাকা অবস্থাতে’ই প্রধানমন্ত্রী হয়েছে এবং সন্তানের মা হয়েছে।
এই ভদ্রমহিলা হচ্ছে সেই প্রধানমন্ত্রী, যিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেশের সকল ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছেন।
করোনা রোগী শনাক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামলেছে জেসিন্ডা। নিউজিল্যান্ড হচ্ছে প্রথম পশ্চিমা দেশ; যারা অন্তত একবারের জন্য হলেও পুরোপুরি করোনা মুক্ত হতে পেরেছে। এখনও বেশ ভালো ভাবেই তারা পরিস্থিতি সামলাচ্ছে। যেখানে ইংল্যান্ড-আমেরিকায় মৃত্যুর মিছিল থামছে’ই না।
সেই নিউজিল্যান্ডে আজ নির্বাচন ছিল।
আমি ভাবছিলাম আজকাল তো পশ্চিমা বিশ্বে সেই অর্থে প্রগতিশীলরা ভোট পায় না। যেই প্রধানমন্ত্রী মসজিদে হামলার প্রথম দিন ঘোষণা করেন- এটা একটা হোয়াইট সন্ত্রাসীর কাজ। যেই প্রধানমন্ত্রী দেশটির অভিবাসী, শরণার্থী, ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠী’র অধিকারের জন্য সরব থাকে; সেই প্রধানমন্ত্রী’কে হয়ত দেশ’টির সংখ্যাগুরু মানুষ ভোট দেবে না।
যেমনটা আমরা দেখতে পাচ্ছি- আমেরিকায় কিংবা ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ড তো অভিবাসীদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে’ই বের হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু দক্ষিণ মেরু’র দেশ নিউজিল্যান্ড এবং দেশ’টির মানুষরা বোধকরি একটু অন্য রকম’ই।
আজকের নির্বাচনে জেসিন্ডার দল ৫০ বছরের ইতিহাসে সব চাইতে বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে।
নির্বাচিত হবার পর জেসিন্ডা আর্ডেন কি বলেছে জানেন? বলেছেন
ধন্যবাদ, আমাদের যারা ভোট দিয়েছেন। তবে আমি শুধু আপনাদের নয়, দেশের সকল মানুষের জন্য কাজ করব। যারা আমাকে ভোট দেয়নি, তাদের জন্যও। আমাদের বর্তমান পৃথিবী এমনিতেই নানা কারণে মেরুকরণ হয়ে গিয়েছে। কেউ কারো মতামত শুনতে চায় না। এই নির্বাচন আমাদের জানান দিয়েছে- জাতি হিসেবে আমরা অন্য যে কারো মতামত শুনতে পারি। ইচ্ছে মতো তর্ক-বিতর্ক করতে পারি। নির্বাচন সব সময় দেশের মানুষকে এক করতে পারে না। কিন্তু এর মানে এই না, আমরা একে-অন্যকে ঘৃণা করব।
এতো বিশাল জয়ের পর’ও এই ভদ্রমহিলা তার বিপক্ষ দল সম্পর্কে একটা খারাপ কথাও বলেনি।
কী চমৎকার ব্যাপার। নিউজিল্যান্ড হচ্ছে এমন একটা দেশ, যেই দেশে তিনটা সরকারি ভাষা। ইংরেজি, মাউরী (দেশটির আদিবাসীদের ভাষা) এবং তৃতীয়’টা কি জানেন?
“সাইন ল্যাংগুয়েজ”
অর্থাৎ যারা কানে শোনে না কিংবা কথা বলতে পারে না; তাদের ভাষাটাও দেশটির সরকারি ভাষার মর্যাদা পেয়েছে।
আমেরিকায় আর দুই সপ্তাহ পর নির্বাচন। দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যেভাবে একে-অপরকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করছে; তাতে বলতেই হচ্ছে- আমেরিকা, ইংল্যান্ড সহ পৃথিবীর সকল দেশের রাজনীতিবিদ’দের উচিত হবে নিউজিল্যান্ড এবং দেশ’টির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেনকে দেখে কিছু শেখা।
আমিনুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অস্ট্রিয়া।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)